আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর রিটেইন আর্নিংস ও রিজার্ভের ওপর ১৫ শতাংশ করারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ কর বাবদ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ২০৯ কোম্পানিকে পরিশোধ করতে হবে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এ ধরনের করারোপকে অযৌক্তিক উল্লেখ করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন। যদিও পুঁজিবাজারে প্রণোদনার অংশ হিসেবে নগদ লভ্যাংশ প্রদানকে উৎসাহিত করতে এ করারোপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে বাজেট প্রস্তাবনায়। রিটেইন আর্নিংস ও রিজার্ভের ওপর ১৫ শতাংশ করারোপের যুক্তি হিসেবে বাজেট প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, পুঁজিবাজারের অনেক কোম্পানির মধ্যে তাদের মুনাফার অর্থ শেয়ারহোল্ডারদের না দিয়ে রিটেইন আর্নিংস ও রিজার্ভ হিসেবে রেখে দেয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এতে শেয়ারহোল্ডাররা প্রত্যাশিত লভ্যাংশ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি পুঁজিবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর এ ধরনের প্রবণতা রোধ করতে বাজেটে কোনো কোম্পানির অবণ্টিত মুনাফা ও সঞ্চিতির পরিমাণ যদি এর পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি হয়, তবে সেক্ষেত্রে যতটুকু বেশি হবে, তার ওপর কোম্পানিকে ১৫ শতাংশ কর প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এ ১৬(জি) নামে একটি নতুন ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে।
রিজার্ভের ওপর করারোপের এ ঘোষণায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের (বিএপিএলসি) পক্ষ থেকে রিজার্ভের ওপর করারোপসংক্রান্ত ধারাটি আয়কর আইন থেকে বাদ দেয়াসহ স্টক লভ্যাংশের ওপর করারোপের বিধান বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে।
বিএপিএলসির প্রেসিডেন্ট আজম জে চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, এনবিআরের রিজার্ভের ওপর করারোপ করাটা ঠিক হয়নি। যেসব কোম্পানি রিজার্ভ রাখছে, তারা কিন্তু শেয়ারহোল্ডারদের ভালো লভ্যাংশ দেয়ার পরই সেটি রাখছে। ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যেই কোম্পানিগুলো রিজার্ভ রাখে। এর ওপর করারোপ করা হলে কোম্পানিগুলোর ব্যবসা সম্প্রসারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে রিজার্ভের ওপর করারোপের বিষয়টি এখনই চূড়ান্ত হয়নি। তাই এটি পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আয়কর আইনে এ-সংক্রান্ত নতুন যে ধারা সংযোজন করা হয়েছে, সেটি বাদ দেয়ার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। তাছাড়া বিষয়টি নিয়ে আমরা এনবিআর চেয়ারম্যান ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করব। আশা করি, সরকার বিষয়টি বিবেচনা করবে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩১৭ কোম্পানির রিটেইন আর্নিংস, রিজার্ভ ও পরিশোধিত মূলধনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০৯টি কোম্পানির রিটেইন আর্নিংস ও রিজার্ভের পরিমাণ এর পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি। কোম্পানিগুলোর মোট পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৫১ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। মোট রিটেইন আর্নিংস ও রিজার্ভের পরিমাণ ৯৭ হাজার ৯০১ কোটি টাকা। মোট পরিশোধিত মূলধনের অর্ধেক বা ৫০ শতাংশ হচ্ছে ২৫ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধনের অতিরিক্ত মোট অর্থের পরিমাণ ৭১ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। এর ১৫ শতাংশ হারে ২০৯ কোম্পানিকে ১০ হাজার ৭৯২ কোটি টাকার কর দিতে হবে। এর মধ্যে ন্যূনতম ১০০ কোটি থেকে সর্বোচ্চ ৭৬২ কোটি টাকা পর্যন্ত কর দিতে হবে
শীর্ষস্থানীয় ২৯ কোম্পানিকে। এ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে মোট কর আসবে ৭ হাজার ৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
সবচেয়ে বেশি ৭৬২ কোটি টাকার কর দিতে হবে রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডকে। এরপর বেশি কর দিতে হবে বেক্সিমকো লিমিটেডকে ৭২২ কোটি টাকা। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসকে রিজার্ভের ওপর ৬৬৫ কোটি টাকার কর দিতে হবে। এছাড়া ইসলামী ব্যাংককে ৩৯৭ কোটি, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোকে ৩৩৩ কোটি, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) ২৮৭ কোটি, ডাচ্-বাংলা ব্যাংককে ২৭৮ কোটি, যমুনা অয়েলকে ২৭৫ কোটি ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসকে ২৩৫ কোটি টাকা দিতে হবে।
বেক্সিমকো গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ও কোম্পানি সচিব এম আসাদ উল্লাহ বলেন, রিজার্ভের ওপর কর পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এটি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এটি শেয়ারবাজারের জন্য প্রণোদনার বদলে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হলে শেয়ারহোল্ডার, তালিকাভুক্ত কোম্পানিসহ পুরো শেয়ারবাজারই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্তের প্রভাবে বাজেট ঘোষণার পরও গতকাল শেয়ারবাজার নিম্নমুখী ছিল। তাই বাজেটে রিজার্ভের ওপর কর প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
রিজার্ভের ওপর কর বাবদ ইউনিক হোটেলকে দিতে হবে ২৩৩ কোটি, রেনাটাকে ২১৪ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংককে ১৯৩ কোটি, পূবালী ব্যাংককে ১৭৬ কোটি ও ইস্টার্ন ব্যাংককে ১৬৭ কোটি টাকা। এর বাইরে এ বাবদ পদ্মা অয়েলকে দিতে হবে ১৬৪ কোটি, মেঘনা পেট্রোলিয়ামকে ১৫৯ কোটি, সামিট পাওয়ারকে ১৫৪ কোটি, সিটি ব্যাংককে ১৫২ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংককে ১৫০ কোটি, ডেসকোকে ১৪৯ কোটি, এসিআই লিমিটেডকে ১৪৬ কোটি, বিএসআরএম লিমিটেডকে ১৪৪ কোটি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংককে (ইউসিবি) ১৪৪ কোটি, একমি ল্যাবরেটরিজকে ১৪০ কোটি, প্রাইম ব্যাংককে ১২১ কোটি, উত্তরা ব্যাংককে ১১৮ কোটি, বিএসআরএম স্টিলকে ১০৭ কোটি, ইউনাইটেড পাওয়ারকে ১০৫ কোটি ও আইডিএলসি ফিন্যান্সকে ১০০ কোটি টাকা। এ শীর্ষ ২৯ কোম্পানির বাইরে বাকি ১৮০টি কোম্পানিকে রিজার্ভের ওপর ৩ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা কর দিতে হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে রিজার্ভ ও রিটেইন আর্নিংসের ওপর যে করারোপ করা হয়েছে, তা ব্যাংকের ওপর কোনোভাবেই কার্যকর হতে পারে না বলে মনে করে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। সংগঠনটির চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, যেকোনো ব্যাংকের পর্ষদ ও শেয়ারহোল্ডাররা নগদ লভ্যাংশ চান। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ হিসেবে আমাদের ইচ্ছাও তাই। কিন্তু প্রভিশনিং ঘাটতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে নগদ লভ্যাংশ দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নগদ লভ্যাংশ দেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নিতে হয়। এ অবস্থায় প্রস্তাবিত বাজেটে কোম্পানির রিজার্ভ ও রিটেইন আর্নিংসের ওপর যে করারোপ করা হয়েছে, সেটি সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। অন্তত ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ ধরনের সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই কার্যকর হতে পারে না। আমরা এ সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করার আহ্বান জানাই।
চূড়ান্ত বাজেট পাস হওয়ার আগে বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস এসেছে এনবিআরের পক্ষ থেকে। গতকাল ২০১৯-২০ অর্থবছরের অর্থ বিল নিয়ে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া বলেন, পুঁজিবাজারের সুবিধার জন্য কোম্পানির রিজার্ভের ওপর ১৫ শতাংশ ট্যাক্স ধার্য করা হয়েছে। কিন্তু সুবিধা দিতে গিয়ে যদি সবার অসুবিধা হয়ে যায়, তবে এ নিয়মের কোনো অর্থ হয় না। আমি মনে করি, শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়ার পর কোম্পানির মুনাফার যে অংশ রিটেইন আর্নিংস হিসেবে রিজার্ভে জমা হবে, তার ওপর ১৫ শতাংশ ট্যাক্স প্রতি বছর কেটে নিলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।