শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশ সরকারকে ৪.৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এর মধ্যে ঋণের দুটি কিস্তির টাকাও ছাড় করেছে সংস্থাটি। তবে ঋণের অনেক শর্তের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বিভিন্ন খাতে কর অব্যাহতি কমিয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিল দাতা সংস্থাটি। শর্তে কর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে পূর্ণ অব্যাহতি, হ্রাসকৃত হারে কর দেওয়া বা কিছু উপকরণের ওপর আংশিক কর দেওয়ার মতো সুবিধা কমানোর কথা বলা হয়েছিল।আইএমএফকে খুশি করতে গিয়ে অব্যাহতি অনেকটাই কমিয়েছে এনবিআর। তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে প্রজ্ঞাপন ও আদেশের মাধ্যমে দেওয়া শুল্ক-কর অব্যাহতি। অর্থবছরের ১০ মাসে ৩৬ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, যা এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা কম। শতকরা হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে অব্যাহতি কমেছে ২৩.৪৯ শতাংশ।তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত মূলধনী যন্ত্রপাতি কিনতে ছয় হাজার ৩১৬ কোটি টাকা ছাড় দিয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল সাত হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে মূলধনী যন্ত্রপাতি কেনায় এক হাজার কোটি টাকারও বেশি অব্যাহতি কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২৩.৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে ২৮৪.৮ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩৭৩ কোটি ডলার।এ ছাড়া অন্যান্য মূলধনী পণ্য আমদানি কমেছে ২১.৮ শতাংশ। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের শিল্পোৎপাদনে।গত সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে দেশের শিল্পোৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ৬.৬৬ শতাংশে নেমে এসেছে, যা কভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর থেকে সর্বনিম্ন। গত বছর এ খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.৩৭ শতাংশ। এর আগের দুই অর্থবছরে শিল্পোৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৯.৮৬ শতাংশ ও ১০.২৯ শতাংশ।
সে বিবেচনায় চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধিতে তীব্র পতন দেখা যাচ্ছে।জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন আইএমএফকে খুশি করার কোনো মিশনে এনবিআর অংশগ্রহণ করেনি। তারা বলেছিল, অব্যাহতি পুরোপুরি তুলে দিতে। আমরা তাদের খুশি করতে পারিনি। আমরা কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর স্বার্থে ধীরে ধীরে অব্যাহতি কমিয়েছি। তবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, সরকার আমদানি কমানোর নীতি নিয়েছে। এলসি কমেছে, তার প্রভাবই পড়েছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে কোনো জটিলতা তৈরি করা হয়নি।তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন সময়ে সরকারি নির্দেশে ও রাজনৈতিক বিবেচনায় ছাড় দিতে হয়। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখতে অব্যাহতি পুরোপুরিভাবে কমিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। শিল্প ও বাজারকে প্রভাবিত করতে পারে এমন কোনো কিছুতে অব্যাহতি কমানো হয়নি।তবে দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোগ্য পণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, অব্যাহতিপ্রাপ্ত যেসব যন্ত্রপাতি আছে, সেগুলোকেও এনবিআর নানা যাচাই-বাছাই করছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, একটা কলম তৈরি করতে গেলে কলম বানানোর মেশিনের সঙ্গে কলমের ক্যাপ বানানোর মেশিন এবং কালি ভরার মেশিনারিজও আনতে হবে। এনবিআর যেটা করছে, তারা কলম বানানোর মেশিনে অব্যাহতি দিচ্ছে, কিন্তু কালি ভরার মেশিনারিজে অব্যাহতি দিচ্ছে না। এটা তো হয় না। এই কাজটাই তারা করেছে।