বঙ্গবন্ধুর নামে থাকা প্রতিষ্ঠানে অনুদানে করছাড় বাতিল করছে সরকারখেজুর আমদানিতে শুল্ক-কর কমলদেশে উৎপাদিত প্রসাধনীতে করের বোঝা, আমদানিতে ছাড়ভোজ্যতেল আমদানিতে কমলো ভ্যাটখেজুর আমদানিতে শুল্ক ও অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের সুপারিশ
No icon

শেয়ারবাজার : উত্থান-পতনে সবচেয়ে প্রভাবশালী ২০ কোম্পানি

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর ওঠানামার ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয় সূচকের উত্থান-পতন। সূচকের অধীন কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধন নির্ধারণে ব্যবহার করা হয় ফ্রি ফ্লোট পদ্ধতি। আর এ পদ্ধতিতে দেশের শেয়ারবাজারে সূচকের ওঠানামায় মূল নিয়ামকের ভূমিকা রাখছে মাত্র ২০টি কোম্পানি। এ কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর বাড়ার বিপরীতে বাজারের অন্যান্য কোম্পানির দর কমলেও দিন শেষে সূচক থাকে ঊর্ধ্বমুখী। বিপরীতে এ কোম্পানিগুলোর দর কমলে তালিকাভুক্ত বাকি কোম্পানির শেয়ারদর বাড়লেও সূচকে প্রতিফলন ঘটে সামান্যই। দেশের শেয়ারবাজারে বর্তমানে বিভিন্ন খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ৩১৪। প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স হিসাব করা হয় মোট ফ্রি ফ্লোট বাজার মূলধনের ভিত্তিতে। প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির সময় যে-সংখ্যক শেয়ার ইস্যু করা হয়, সেগুলোই ফ্রি ফ্লোট শেয়ার। প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ইস্যু করা শেয়ারের ওপর লকইন পিরিয়ড থাকা পর্যন্ত সেগুলো ফ্রি ফ্লোট শেয়ার হিসেবে গণ্য হয় না। এর বাইরে উদ্যোক্তা-পরিচালক, সরকার এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শেয়ারধারীর কাছে থাকা শেয়ারগুলোও ফ্রি ফ্লোট শেয়ার নয়।

বাজার মূলধন নির্ধারণে ফ্রি ফ্লোট পদ্ধতিকে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ লেনদেনের জন্য সক্রিয় থাকা শেয়ারগুলোর ভিত্তিতে এটা নির্ধারণ করা হয় বলে বাজারের গতিপ্রকৃতির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য চিত্রও উঠে আসে।

১১ এপ্রিল শেষ হওয়া সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ডিএসইর মোট বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ৯৭ হাজার ৬২১ কোটি ৩৭ লাখ ৬৬ হাজার ৮৩৯ টাকা। এর মধ্যে ফ্রি ফ্লোট শেয়ারগুলোর বাজার মূলধন ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার ৬৪৮ কোটি ২৫ লাখ ৯০ হাজার ২৩৩ টাকা, যা মোট বাজার মূলধনের প্রায় ৩৩ শতাংশ। অন্যদিকে ফ্রি ফ্লোট শেয়ারের ভিত্তিতে ২০ কোম্পানির মোট বাজার মূলধন ছিল ৬১ হাজার ৫৩৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট ফ্রি ফ্লোট বাজার মূলধনের ৪৭ দশমিক ১০ শতাংশই এ ২০টি কোম্পানির দখলে।

ফ্রি ফ্লোট বাজার মূলধন বিবেচনায় শীর্ষে অবস্থান ওষুধ খাতের কোম্পানি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের। বাজারের মোট ফ্রি ফ্লোট মূলধনের ১০ দশমিক ৪০ শতাংশই কোম্পানিটির দখলে। কোম্পানিটির শেয়ারদর ৫ শতাংশ পরিবর্তন হলে ডিএসইএক্স কমে-বাড়ে দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমান সূচক বিবেচনায় যা ২৬ দশমিক ৬৩ পয়েন্ট।

তামাক খাতের বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি (বিএটিবিসি) লিমিটেড এক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। মোট ফ্রি ফ্লোট মূলধনের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ তাদের দখলে। বিএটিবিসির শেয়ারদরে ৫ শতাংশ পরিবর্তন ঘটলে সূচকও পরিবর্তন হয় প্রায় ১৬ পয়েন্ট।

বাজার মূলধনের দিক দিয়ে শেয়ারবাজারের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি হলেও ফ্রি ফ্লোট শেয়ারের হিসাবে বাজার মূলধনে গ্রামীণফোনের অবস্থান তৃতীয়। কোম্পানির দখলে রয়েছে মোট ফ্রি ফ্লোট বাজার মূলধনের ৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। গ্রামীণফোনের শেয়ারদরে ৫ শতাংশ উত্থান-পতন হলে সূচকে এর প্রতিফলন ঘটবে ১০ দশমিক ৬৫ পয়েন্ট।

চতুর্থ অবস্থানে থাকা রেনাটার দখলে রয়েছে মোট ফ্রি ফ্লোট বাজার মূলধনের ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এর শেয়ারদর ৫ শতাংশ পরিবর্তন হলে সূচক পরিবর্তন হবে ১০ দশমিক ৬৫ পয়েন্ট।

পঞ্চম অবস্থানে থাকা ব্র্যাক ব্যাংকের দখলে রয়েছে মোট ফ্রি ফ্লোট বাজার মূলধনের ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। ব্যাংকটির শেয়ারদর ৫ শতাংশ ওঠানামা করলে ডিএসইএক্সও ওঠানামা করবে ১০ দশমিক ৬৫ পয়েন্ট পর্যন্ত।

ফ্রি ফ্লোট পদ্ধতি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদ ওসমান ইমাম বলেন, আগে বাজারের মোট মূলধনের ভিত্তিতে সূচক হিসাব করা হতো। এখন ফ্রি ফ্লোট পদ্ধতিতে হিসাব করা হচ্ছে। কারণ ফ্রি ফ্লোট শেয়ারের ভিত্তিতে সূচক হিসাব করা না হলে বাজারের প্রকৃত চিত্র প্রতিফলিত হয় না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সূচকে ফ্রি ফ্লোট বাজার মূলধনের ভিত্তিতে শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলোর শেয়ারদরের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এক্ষেত্রে বাজার স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জে বাজার মূলধনের আকার অনুসারে প্লাটফর্ম পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন। যেমন বড় মূলধনি কোম্পানি, মাঝারি মূলধনি কোম্পানি ও ছোট মূলধনি কোম্পানির জন্য আলাদা প্লাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে।

শেয়ারবাজারে জানুয়ারির শেষ দিকে শুরু হওয়া দরপতনের ধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ডিএসইর ব্রড ইনডেক্সটি একদিনে ১ শতাংশ বা তার বেশি পয়েন্ট হারিয়েছে ৩১ জানুয়ারি, ২৪ মার্চ, ৩ এপ্রিল, ৮ এপ্রিল, ৯ এপ্রিল ও ১০ এপ্রিল। ৩১ জানুয়ারি গ্রামীণফোনের শেয়ারদর কমেছিল ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, স্কয়ার ফার্মার ১ দশমিক ৩, ব্র্যাক ব্যাংকের ৩ দশমিক ৪, বেক্সিমকো ফার্মার ১ দশমিক ৭ ও ইসলামী ব্যাংকের ১ দশমিক ৮ শতাংশ।

এপ্রিলের ভীতিজাগানিয়া পতনেও সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল গ্রামীণফোন, ইউনাইটেড পাওয়ার, ব্র্যাক ব্যাংক, অলিম্পিক, স্কয়ার ফার্মার মতো শেয়ারগুলোর দরপতন। চলতি মাসের প্রথমার্ধে বড় মূলধনি কোম্পানিগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ দর হারিয়েছে ইউনাইটেড পাওয়ার। এ সময়ে গ্রামীণফোনের দর কমেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, স্কয়ার ফার্মার ২ দশমিক ৫ ও অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। গতকাল পর্যন্ত হিসাব করলে এপ্রিলে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ পড়ে গেছে ডিএসইএক্স।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সাবেক প্রেসিডেন্ট মোস্তাক আহমেদ সাদেক এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশের শেয়ারবাজারের অব্যাহত পতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। হাতেগোনা কিছু কোম্পানির শেয়ারদরের ওপর সূচকের নির্ভরশীলতা বাজারের জন্য মোটেই ভালো নয়। কারণ শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারদর ওঠানামা করলেই বাজারে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বাজারে বড় মূলধনি কোম্পানিকে নিয়ে আসতে হবে। আর ভালো ও বড় মূলধনি কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করতে হলে স্টক এক্সচেঞ্জ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।

ফ্রি ফ্লোট বাজার মূলধনের শীর্ষ তালিকার ষষ্ঠ থেকে ষোড়শ স্থানে থাকা অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, ইসলামী ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ, ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন, ন্যাশনাল ব্যাংক, সামিট পাওয়ার, বেক্সিমকো ও সিটি ব্যাংকের শেয়ারদরে ৫ শতাংশ পরিবর্তন হলে সূচক পরিবর্তন হবে ৫ দশমিক ৩৩ পয়েন্ট। আর শীর্ষ তালিকার সপ্তদশ থেকে বিংশতম অবস্থানে থাকা প্রাইম ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) শেয়ারদর ৫ শতাংশ পর্যন্ত পরিবর্তন হলে সূচকে তেমন প্রভাব পড়বে না। তবে ৫ শতাংশের বেশি পরিবর্তন হলে সূচকে এর প্রভাব দেখা যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত শেয়ারগুলোর দরের ভিত্তিতে সূচক ওঠানামা করবে এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে যেসব কোম্পানির ফ্রি ফ্লোট বাজার মূলধন বেশি, সূচকে সেগুলোর প্রভাবই বেশি থাকবে। এ ধরনের কোম্পানির শেয়ারদরে উত্থান-পতন হলে সূচকেও তার প্রভাব প্রতিফলিত হবে। আমি মনে করি, বাজারে স্থিতিশীলতার জন্য এ ধরনের বড় মূলধনি কোম্পানির তালিকাভুক্তি বাড়ানো প্রয়োজন।