প্রস্তাবিত বাজেটে ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমের বিজ্ঞাপনকে ভ্যাটের আওতায় আনতে সোশ্যাল মিডিয়া ও ভার্চুয়াল বিজনেস-এর সংজ্ঞা দেওয়া হয়। সেখানে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এ সংজ্ঞায় পড়ে গেছে ই-কমার্স বা অনলাইন কেনাকাটা। ফেসবুক, গুগল ও ইউটিউবকে ধরতে গিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাটের খড়্গ পড়েছে ই-কমার্স খাতের ওপর। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে অনলাইন কেনাকাটায় ৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছিল। এতে ই-কমার্স, ফেসবুক কমার্স বা এফ-কমার্সসহ ইন্টারনেট মাধ্যমে সব কেনাকাটায় ভ্যাট যুক্ত করার কথা বলা হয়। পরে এটি ছাপার ভুল বলে জানিয়েছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। বাজেট পাসের সময় এই ভ্যাট আর রাখা হয়নি। তবে নতুন বাজেটে ই-কমার্স খাতে নতুন করে ভ্যাট বসায় দেশে এই খাতের প্রসার ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন উদ্যোক্তারা।
জানতে চাইলে দেশের সফটওয়্যার ও তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর সেবা খাতের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর গতকাল শুক্রবার বলেন, উদীয়মান ই-কমার্স খাতে অসংখ্য শিক্ষিত তরুণ নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলছে। এতে প্রচুর কর্মসংস্থান যেমন হচ্ছে, তেমনি সরকার যে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে তাতে বড় ভূমিকা রাখছে ই-কমার্স খাত। অন্তত পাঁচ বছরের জন্য হলেও এই খাতের প্রসার ঘটতে দেওয়া উচিত। তা না হলে অসংখ্য তরুণ উদ্যোক্তা পথে বসবে। প্রস্তাবিত বাজেটে ভার্চুয়াল বিজনেস ক্যাটাগরিতে ফেলে এই খাতে যে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে ভোক্তারাও অনলাইন কেনাকাটায় নিরুৎসাহ হবে।
ভারতের ই-কমার্সে প্রতিদিন ৫০ লাখ ডেলিভারি হয়। বাংলাদেশে হয় মাত্র ৩০-৪০ হাজার। তুলনায় এক শ ভাগের এক ভাগও নয়। এই খাতের বিকাশে ভ্যাটকে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন ই-জেনারেশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও অন্যতম ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বাগডুম ডটকমের নির্বাহী চেয়ারম্যান শামীম আহসান। গতকাল তিনি বলেন, প্রচলিত বাজারের বেশির ভাগই ভ্যাট দিচ্ছে না। সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট বসলে অনলাইনে কেউ কেনাকাটা করবে না। অনলাইন কম্পানি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে অনেকে। চলতি বাজেটে কোনো ভ্যাট না থাকলেও প্রস্তাবিত বাজেটে ভার্চুয়াল বিজনেসের মধ্যে ই-কমার্সকে সংজ্ঞায়িত করে এই ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। আসলে ই-কমার্স ভার্চুয়াল বিজনেস নয়। এটা অন্যায় হয়েছে।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল গতকাল বলেন, মানুষ এখন অনলাইনে কেনাকাটা শুরু করেছে। এ অবস্থায় ভ্যাট আরোপ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে অন্তরায় হয়ে যায়। ই-কমার্স ও এফ-কমার্সে বর্তমানে ৫০ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা জড়িত। তাদের জীবিকাও হুমকির মুখে পড়বে। কারণ ভ্যাট বহন করার মতো আর্থিক সক্ষমতা এসব উদ্যোক্তার নেই। তাই চূড়ান্ত বাজেটে বিষয়টি বিবেচনা করে আগের অবস্থা বহাল রাখার দাবি জানাচ্ছি।
দেশে অনলাইনে ব্যবসার আকার এক হাজার কোটি টাকার মতো। এখন প্রায় দুই হাজার ই-কমার্স সাইট এবং ৫০ হাজার ফেসবুকভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিদিন দেশের মধ্যে ডেলিভারি হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার পণ্য। অনলাইনে বিক্রি হওয়া পণ্যের ৮০ শতাংশ যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও গাজীপুরে। এ খাতকে নিয়মের মধ্যে আনতে সরকার ২০১৮ সালে জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা করেছে বলে জানান তমাল।
তৃণমূলের অনেক নারী উদ্যোক্তা ই-কমার্সের মাধ্যমে তাদের হস্তাশিল্পসহ নানা পণ্য দেশে-বিদেশে বিক্রি করে স্বাবলম্বী হচ্ছে বলে জানান ই-ক্যাবের যুগ্ম সম্পাদক ও সিটি অনলাইন মার্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা নাসিমা আক্তার নিসা। কিন্তু ই-কমার্সে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাটের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ভোক্তা-উদ্যোক্তা সবার ওপর। ই-কমার্স ভার্চুয়াল সার্ভিস নয়। তিনি বলেন,আমরা সব সময় চেয়ে আসছি পাঁচ বছরের জন্য ভ্যাটমুক্ত রাখার। কিন্তু এই খাত বিকশিত হওয়ার আগে একে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেওয়া ঠিক হবে না। নতুন একটি খাতকে বড় করার জন্য আমরা নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পাঁচ বছর সময় চাই।
শুধু ই-কমার্স নয়, এই ভ্যাট দিতে হবে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে যারা পণ্য বিক্রি করে তাদেরও। অনলাইন কেনাকাটায় এই ক্যাটাগরি এফ-কমার্স হিসেবে পরিচিত। দেশে বর্তমানে এমন হাজার হাজার ছোট ছোট উদ্যোক্তা রয়েছে। আগে একটি আলাদা সেবা কোডে অনলাইন কেনাকাটাকে অন্তর্ভুক্ত করে ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হয়েছিল। এবার সেখানে অন্য একটি সেবা ঢুকেছে। আর ফেসবুক ও ইউটিউবের বিজ্ঞাপন-ব্যবসায় করারোপে নতুন যে আলাদা খাত সংজ্ঞায়িত হলো সেখানে ই-কমার্স ঢুকে গেছে। এতে ই-কমার্সের ওপরও সাড়ে ৭ শতাংশ করের খড়্গ পড়েছে।