নতুন মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইনে উৎসে কর কর্তনের আওতা ব্যাপক বাড়ানো হয়েছে। সরকারি-বেসরকারিসহ সব প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের ভ্যাট কর্মকর্তারা বলেছেন, দেশের ৯০ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রিটার্ন জমা দেয় না। ফলে নতুন আইন বাস্তবায়নে অনেক ক্ষেত্রে আদায় নিয়ে জটিলতা দেখা দেবে। বাজেট ঘোষণার পর নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের বিষয়ে গতকাল পর্যন্ত এনবিআর থেকে কোনো দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবের মাধ্যমে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক্ক আইন-২০১২-তে অনেক সংশোধনী আনা হয়েছে। এতে ভ্যাটের হার আটটি করা হয়েছে। আগের আইনে হার ছিল পাঁচটি। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ভ্যাট আইন-১৯৯১-এর কার্যকারিতা রয়েছে। নতুন আইন পাস করার পর ব্যবসায়ীদের আপত্তির মুখে এর বাস্তবায়ন কয়েক দফা পেছানো হয়। এবার বাজেট ঘোষণার আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমঝোতা হয়। আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন আইন বাস্তবায়ন শুরু হবে।
আগের আইনে বার্ষিক ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভার বা বিক্রয়ের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি সীমা ছিল। এ সীমা ৫০ লাখ টাকা করা হয়েছে। অব্যাহতি সীমায় ছাড় দেওয়া হলেও করহার বাড়ানো হয়েছে। ৫০ লাখ টাকা থেকে তিন কোটি পর্যন্ত বিক্রি হলে টার্নওভার কর দিতে হবে। টার্নওভারের ওপর কর ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে।
আইন অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা স্বপ্রণোদিত হয়ে তাদের বার্ষিক বিক্রির ঘোষণা দেবেন এবং তা মেনে নিতে বাধ্য ভ্যাট কর্মকর্তারা। ইচ্ছা করলেই কেউ টার্নওভার কম দেখাতে পারবেন। সঠিক পরিমাণ নিশ্চিত করার কোনো কৌশল বা নীতিমালা তৈরি করা হয়নি। একজন ভ্যাট কমিশনার বলেন, যারা ভ্যাট দেন, তারা সবাই বিক্রি কম দেখাতে চাইবেন। এ বিষয়ে নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকায় ভ্যাট আদায় ব্যাহত হতে পারে।
স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট আদায়ের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে উৎসে কর্তন। ঠিকাদারি থেকে সবচেয়ে বেশি উৎসে কর্তন করা হয়। ভ্যাট কর্মকর্তারা বলেছেন, সিংহভাগ ঠিকাদার ভ্যাট রিটার্ন জমা দেন না। নতুন আইনে তাদের সবাইকে ভ্যাটের আওতায় এনে রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি খাতের কেনাকাটা হচ্ছে উৎসে ভ্যাট আহরণের অন্যতম খাত। দেশে তিন লাখের বেশি সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে। নতুন আইনে এসব প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলক নিবন্ধনের আওতায় এনে রিটার্ন জমা দিতে হবে। এনবিআর সূত্র জানায়, প্রায় দুই লাখ প্রতিষ্ঠান ভ্যাট নিবন্ধন নিলেও মাত্র ৪০ হাজার বার্ষিক রিটার্ন জমা দেয়। রিটার্ন জমার ভিত্তিতে ভ্যাট আদায় করা হয়। ভ্যাট কর্মকর্তারা মনে করেন, নতুন আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়নে যে ধরনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি দরকার, মাঠ পর্যায়ে এর ঘাটতি আছে। এ ছাড়া নতুন ভ্যাট আইন সম্পর্কে অনেক কর্মকর্তার স্বচ্ছ ধারণা নেই। এ অবস্থায় পুরোপুরি প্রস্তুতি ছাড়া এ আইন বাস্তবায়নের ফলে আদায় কার্যক্রমে জটিলতা ও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
ভ্যাটের আট স্তর :নতুন আইনে ভ্যাটের বড় স্তর চারটি। এগুলো হলো- ৫, সাড়ে ৭, ১০ এবং ১৫ শতাংশ। এর বাইরে জমি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ, ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে ২ ও ৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং সরবরাহ পর্যায়ে পেট্রোলিয়াম পণ্যে ২ শতাংশ এবং সরবরাহ পর্যায়ে ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ২ দশমিক ৪ শতাংশ। জমি, ওষুধ এবং পেট্রোলিয়াম পণ্যের ভ্যাটহার আগে যা ছিল, তা বহাল রাখা হয়েছে। ফ্ল্যাট নিবন্ধনের ক্ষেত্রে তিনটি স্তরের পরিবর্তে নতুন করে দুটি করা হয়েছে। এ ছাড়া রডের ক্ষেত্রে প্রতি টনে দুই হাজার টাকা ভ্যাট নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নতুন আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভাট আদায় প্রক্রিয়া আধুনিকায়ন ও সহজ করা। কিন্তু অনেক রেট করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার পরিপন্থি। উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালের আইনে ভ্যাটের মোট পাঁচটি হার ছিল।
যেসব পণ্য বা খাতে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে :তরল দুধ থেকে গুঁড়া দুধ উৎপাদন, গুঁড়া মরিচ, ধনিয়া, আদা, হলুদ বা এসব মসলার মিশ্রণ, মেশিনে প্রস্তুত বিস্কুট, চাটনি, আম, আনারস, পেয়ারার জুস, এলপি গ্যাস, প্লাস্টিকের তৈরি সব ধরনের টেরিটাওয়েল, শিপ স্ট্ক্র্যাপ, সিআর কয়েল, তারকাঁটা, অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি গৃহস্থালি সামগ্রী, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফার, বিদ্যুৎ, স্বর্ণ ও রৌপ্য, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ইত্যাদি। এনবিআর সূত্র বলেছে, এসব পণ্যে আগে বিশেষ ছাড় দিয়ে ট্যারিফ মূল্যে ভ্যাট আদায় করা হতো। এখন থেকে পণ্যের প্রকৃত বা বাজারমূল্যে ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করা হবে। এতে কোনো পণ্যের দাম বাড়বে, কোনো পণ্যের দাম কমতে পারে। অন্যদিকে, হোটেল-রেস্তোরাঁ (নন-এসি), ডুপ্লেক্স বোর্ড, সিগারেট-বিড়ি পেপার, নির্মাণ সংস্থা ইত্যাদির ভ্যাটের হার সাড়ে ৭ শতাংশ। ডকইয়ার্ড, ছাপাখানা, টেইলারিং, লটারি টিকিটসহ অন্যান্য সেবা খাতে আগের মতো ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বাইরে অন্য সব খাতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।
২৫ সেবা ও পণ্যে ইএফডি মেশিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক :ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে বাজেটে ২৫ খাতে আধুনিক প্রযুক্তির তৈরি হিসাব যন্ত্র বা মেশিন ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সরকার প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার মেশিন কিনে বিনামূল্যে ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করবে। এ জন্য বাজেটে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এসব মেশিনের ব্যবহার বাড়ানো হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার ৫০ লাখ টাকার বেশি, তাদের ইএফডি মেশিন অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে।
ইএফডি হচ্ছে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার বা ইসিআরের উন্নত সংস্করণ। অত্যাধুনিক এই যন্ত্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসানো হবে। এর মাধ্যমে প্রতিদিন যে পরিমাণ বিক্রি হবে, তার তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে তদারক করতে পারবেন এনবিআরের কর্মকর্তারা। এর ফলে ভ্যাট আদায় বর্তমানের চেয়ে অনেক বাড়বে বলে আশা করছে সরকার। খাতগুলো হচ্ছে :আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ ও ফাস্টফুডের দোকান, ডেকোরেটরস ও ক্যাটারার্স, মোটরগাড়ির গ্যারেজ, ওয়ার্কশপ, ডকইয়ার্ড, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, ছাপাখানা ও বাঁধাই সংস্থা, কমিউনিটি সেন্টার, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, রৌপ্যকার ও স্বর্ণকার এবং স্বর্ণ পাকাকারী, আসবাবপত্রের বিক্রয়কেন্দ্র, কুরিয়ার ও এক্সপ্রেস মেইল সার্ভিস, বিউটি পার্লার, হেলথ ক্লাব ও ফিটনেস সেন্টার, কোচিং সেন্টার, সামাজিক ও খেলাধুলাবিষয়ক ক্লাব, তৈরি পোশাক বিপণন, ইলেকট্রনিক বা ইলেকট্রিক্যাল গৃহস্থালি সামগ্রীর বিক্রয়কেন্দ্র, শপিং সেন্টার, শপিংমল, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, জেনারেল স্টোর, সুপারশপ, অন্যান্য বড় ও মাঝারি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, যান্ত্রিক লন্ড্রি, সিনেমা হল, সিকিউরিটি সার্ভিস ও বোর্ড বা কমিশনার কর্তৃক নির্ধারিত অন্য যে কোনো পণ্য বা সেবা সরবরাহকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।