একাধিক ভ্যাট হার, টার্নওভার ট্যাক্স ও ভ্যাট অব্যাহতির সীমা বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হলেও নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তা কাটেনি। ট্যারিফ মূল্য প্রথা বিলুপ্তির পর সেসব পণ্যের ভ্যাট হার কত হবে, সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য পণ্য সংখ্যা কমবে কি না, ডিউটি ড্রব্যাকের ক্ষেত্রে আমদানি শুল্কের ড্রব্যাক কোন দফতর থেকে নিতে হবে- এসব প্রশ্নে দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা। এনবিআর-এফবিসিসিআইয়ের পরামর্শ কমিটির আজকের সভায় এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইবেন ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে উৎপাদন পর্যায়ে ৮৫টি পণ্যে ট্যারিফ মূল্য নির্ধারিত আছে। এর মধ্যে গুঁড়া দুধ, গুঁড়া মসলা, বিস্কুট, কেক, রুটি, আচার, টমেটো সস, ফলের জুস, এলপি গ্যাস, নিউজপ্রিন্ট, সব ধরনের কাগজ, এলইডি লাইট, টিউবলাইট, চশমা, সানগ্লাস, নির্মাণসামগ্রী যেমন: রড, ইট রয়েছে। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে এসব পণ্যের ট্যারিফ মূল্য থাকবে না। তখন প্রকৃত দামের ওপর উৎপাদকদের ভ্যাট দিতে হবে, ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়বে।
উদাহরণস্বরূপ, এক কেজি হলুদ গুঁড়ার উৎপাদন খরচ ১০০ টাকা। বর্তমান নিয়মে এক কেজি হলুদ গুঁড়ার ট্যারিফ মূল্য ৪০ টাকা। এই টাকার ওপর ১৫ শতাংশ হারে, অর্থাৎ ৬ টাকা ভ্যাট দিতে হয়। নতুন ভ্যাট আইনে ট্যারিফ মূল্য প্রথা বিলুপ্ত হলে উৎপাদন খরচ ১০০ টাকার ওপরে ১৫ শতাংশ হারে অর্থাৎ ১৫ টাকা ভ্যাট দিতে হবে। অন্যদিকে বর্তমানে ১১-৩০ কেজি আকারের এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের ট্যারিফ মূল্য ৬০ টাকা। যার ওপর ১৫ শতাংশ হারে ৯ টাকা ভ্যাট দিতে হয়।
ট্যারিফ প্রথা বিলুপ্ত হলে প্রকৃত মূল্যের ওপর ভ্যাট দিতে হবে। সিলিন্ডারের প্রকৃত মূল্যের (৮৮৮ টাকা ধরে) ওপর যদি ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয় তাহলে ১৩৩ টাকা ভ্যাট দিতে হবে। অন্যদিকে নতুন ভ্যাট আইনে সম্পূরক শুল্ক আরোপিত পণ্যের সংখ্যা কমানো হবে কি না, তা নিয়েও সংশয়ে ব্যবসায়ীরা।
আইটেমভিত্তিক পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক কতটুকু কমানো হবে, নাকি শুল্ক হার অপরিবর্তিত থাকবে, তা নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করেনি এনবিআর। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইনে আমদানি পর্যায়ে মোট ১ হাজার ৪৩১ ট্যারিফ লাইনের বিপরীতে বিভিন্ন হারে সম্পূরক শুল্ক ছিল।
নতুন আইনে মাত্র ২৫৬টি ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক রাখা হয়েছে। এতে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা কমবে। আমদানি পণ্যের কাছে মার খাবে দেশীয় পণ্য। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বর্তমানে শুল্ক রেয়াত ও প্রত্যর্পণ পরিদফতর (ডেডো) থেকে রফতানিকারকরা শুল্ক ও ভ্যাটের রেয়াত নেন। পাশাপাশি ডেডো রফতানির উদ্দেশ্যে উৎপাদিত পণ্যের সহগ ও সমহার নির্ধারণ করে (সহগ হচ্ছে পণ্য তৈরিতে যেসব উপাদান ব্যবহার হয় তার একক ও সমহার হচ্ছে একই ধরনের পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণের শুল্ককর ফেরতের পদ্ধতি)।
নতুন ভ্যাট আইনে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের তালিকায় ডেডো রাখা হয়নি। ফলে আইন বাস্তবায়নের পরপরই ডেডোর বিলুপ্তি ঘটবে। তখন রফতানিকারকদের রিফান্ড পেতে ঝামেলায় পড়তে হবে। যদিও নতুন আইনে ভ্যাট রিফান্ড সংশ্লিষ্ট ভ্যাট কমিশনারেটর থেকে নেয়ার কথা বলা আছে। কিন্তু শুল্কের ফেরত কোন দফতর থেকে নিতে হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।
সামগ্রিক দুশ্চিন্তার কথা জানিয়ে গত ১৮ এপ্রিল এফবিসিসিআই থেকে এনবিআরকে চিঠি দেয়া হয়। এতে বলা হয়, খাতভিত্তিক ভ্যাট হার নির্ধারণের জন্য এনবিআর ও এফবিসিসিআইয়ের সমন্বয়ে একটি যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন এবং এফবিসিসিআই থেকে ৩ জন প্রতিনিধির নাম মনোনয়ন দেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এনবিআর থেকে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক পত্র না পাওয়ায় প্রতিনিধিদের নাম পাঠাতে পারছি না।
উদ্বেগ জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, আগামীতে ভ্যাট আইনে ট্যারিফ ভ্যালুর পরিবর্তে ভ্যাটের হার নির্ধারণ, সেবা খাতের মূল্যভিত্তির পরিবর্তে কী হারে ভ্যাট নির্ধারণ হবে এবং সম্পূরক শুল্কসহ অব্যাহতির তফসিল সম্পর্কিত সরকারের অবস্থান এখনও পরিষ্কার করা হয়নি।
অন্যদিকে একাধিক হারে ভ্যাট নির্ধারণের কথা বলা হলেও রেয়াত নেয়ার বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা রয়েছে। কারণ ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট দেয়ার পর রেয়াত দেয়া না হলে তা এক্সাইজ ট্যাক্স হিসেবে বিবেচিত হবে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়নে কী ধরনের প্রভাব পড়বে তা অ্যাসেসমেন্ট করতে এফবিসিসিআই থেকে অনুরোধ করা হলেও এখনও সে উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ ছাড়া ভ্যাটের একাধিক হার বাস্তবায়ন করা হলে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির প্রভাবসহ সার্বিক অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে, জাতীয় স্বার্থে তা বিশ্লেষণ করার তাগিদ দিয়েছে এফবিসিসিআই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে ব্যবসায়ীরা যেভাবে এগিয়ে গেছে, সরকারের দফতরগুলো সেভাবে এগোয়নি। সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আইনটি ব্যবসাবান্ধব করে তুলতে প্রধানমন্ত্রী ২ বছর সময় দিয়েছিলেন।
কিন্তু এনবিআরের তরফ থেকে তার লক্ষণ দেখা যায়নি। কোন পণ্যে ভ্যাট হার কত হবে, সেটা নির্ধারণে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের কথা থাকলেও এনবিআর সেটা করেনি। চিঠি দিয়েও উত্তর পাওয়া যায়নি।
তিনি আরও বলেন, কোন পণ্যের ওপর ভ্যাট কত হবে, সেটা সুচারুভাবে ব্যবসায়ীদের জানাতে হবে। এ জন্য ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করতে বলেছিলাম। কিন্তু সেটা করা হয়নি। বৈশ্বিক অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে দেশের অর্থনীতিও ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে।
এ অবস্থায় অপরিকল্পিতভাবে আইনটি বাস্তবায়ন হলে অর্থনীতিতে সুফল আসবে না। এনবিআর-এফবিসিসিআইয়ের পরামর্শক কমিটির সভায় ভ্যাট আইনের সম্পূরক শুল্ক, ট্যারিফ ভ্যালুসহ অন্য অমীমাংসিত বিষয়ে এনবিআরের অবস্থান জানতে চাইব।
আজ এনবিআর-এফবিসিসিআইয়ের পরামর্শক কমিটির সভা : ৪০তম পরামর্শক কমিটির সভায় আজ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সভাপতিত্ব করবেন এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন।
এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া উপস্থিত থাকবেন। এফবিসিসিআই তাদের বাজেট প্রস্তাব অর্থমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরবে। এতে ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধি, কর্পোরেট কর হ্রাস, অনগ্রসর এলাকায় শিল্প স্থাপনে কর রেয়াত সুবিধা অব্যাহত রাখা, আয়কর কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা হ্রাস, মধ্যবর্তী কাঁচামালের শুল্ক হ্রাসসহ একগুচ্ছ প্রস্তাব দেয়া হবে।
সভায় ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেবে এফবিসিসিআই। একই সঙ্গে ন্যূনতম কর ৫ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ৪ হাজার টাকা নির্ধারণ, সোয়া ২ কোটি টাকা থেকে সারচার্জের সীমা বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা এবং স্ল্যাব বৃদ্ধির প্রস্তাব দেবে সংগঠনটি। সব ধরনের কর্পোরেট ট্যাক্স কমানোর পক্ষে প্রস্তাব দেয়া হবে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর্পোরেট কর ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির কর্পোরেট ট্যাক্স ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে উৎপাদনশীল কোম্পানির জন্য ৩০ শতাংশ এবং ট্রেডিং কোম্পানির জন্য ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ করার প্রস্তাব দেয়া হবে।
মার্চেন্ট ব্যাংকের ক্ষেত্রে কর্পোরেট কর ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৫ শতাংশ, বিদেশি কোম্পানির প্রত্যাবাসনযোগ্য মুনাফার ওপর কর ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ, আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ এবং রফতানির বিপরীতে উৎসে কর দশমিক ২৫ শতাংশ বহাল রাখার প্রস্তাব দেবে এফবিসিসিআই।
এ ছাড়া যেসব কাঁচামাল দেশে উৎপাদিত হয় না সেগুলোর আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ, মধ্যবর্তী কাঁচামালের শুল্ক ১০ শতাংশ, যেসব মধ্যবর্তী কাঁচামাল দেশে উৎপাদন হয় তার শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ এবং বিলাসজাতীয় পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ আমদানি শুল্কের পাশাপাশি সম্পূরক শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দেবে এফবিসিসিআই।