প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট আপিলের খরচ বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। আগামী ১ জুলাই থেকে এ বিধান কার্যকর হবে। অযৌক্তিক ভ্যাট মামলা দায়েরের প্রবণতা হ্রাসে এ উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, এ উদ্যোগ ব্যবসা সহজীকরণ ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। এটি ব্যবসায়ীদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটালকে সংকুচিত করবে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অযৌক্তিক মূসক মামলা দায়েরের প্রবণতা হ্রাসের লক্ষ্যে আপিলাত ট্রাইব্যুনাল ও আপিলাত আপিল কমিশনারেটে আপিল দায়েরের ক্ষেত্রে তর্কিত আদেশে উল্লেখিত দাবিকৃত করের ১০ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ অর্থ পরিশোধের প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব বাস্তবায়নে অর্থবিলের মাধ্যমে ভ্যাট আইনের ১২১ ও ১২২ ধারা সংশোধন করা হয়।
এ বিষয়ে এফবিসিসিআই সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বিষয়টি ঠিক হয়নি। এফবিসিসিআই এটি নিয়ে কাজ করছে। বাজেট পাসের আগে সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা হবে।
ভ্যাট আইনের ১২১ ধারায় বলা আছে, ভ্যাট কর্মকর্তা ব্যতীত সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তর্কিত আদেশের বিরুদ্ধে ৯০ দিনের মধ্যে দাবিকৃত করের ১০ শতাংশ জমা দিয়ে আপিল কমিশনারের কাছে আপিল করতে পারবেন। তবে কমিশনার চাইলে আরও ৬০ দিন সময় দিতে পারবেন। একইভাবে ১২২ ধারার অধীনে আপিলাত ট্রাইব্যুনালেও তর্কিত করের ১০ শতাংশ দিয়ে আবেদনের সুযোগ রয়েছে।
নিয়মানুযায়ী, অতিরিক্ত কমিশনার পদমর্যাদার নিচের কোনো কর্মকর্তার আদেশে সংক্ষুব্ধ হয়ে করদাতা আপিল কমিশনারের কাছে আবেদন করতে পারেন। আপিল কমিশনারের আদেশে সন্তুষ্ট না হলে আপিতাল ট্রাইব্যুনালে আবেদন করা যায়। এ ট্রাইব্যুনালেও ন্যায়বিচার না পেলে উচ্চ আদালতে মামলা করার সুযোগ রয়েছে। তবে সেক্ষেত্রেও আইনের ১২৪ ধারা ১০ শতাংশ জমা দেয়ার বিধান রয়েছে। অর্থাৎ করদাতা সবগুলো ধাপে আবেদন করলে তাকে নতুন করে তর্কিত ভ্যাটের ৫০ শতাংশ জমা দিতে হবে। এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, আপিলের হার কম হওয়ায় অনেক অসাধু ব্যবসায়ী সময়মতো রাজস্ব পরিশোধ না করতে অহেতুক আইনের আশ্রয় নেয়। আপিল করলে এসব মামলা শেষ হতে বছরের পর বছর সময় লেগে যায়। ফলে সরকারের ওই রাজস্ব আটকে রাখা যায়। কিছু ব্যবসায়ী রয়েছেন, তারা সব সময়ই এই কাজটি করে থাকেন। দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ায় এনবিআর মামলায় জয়লাভ করলেও শুধু ওই তর্কিত কর আদায় করা হয়। কিন্তু অহেতুক সময়ক্ষেপণ করে সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করার কারণে ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার প্রচলিত আইন নেই। তাই অযৌক্তিক মামলা হ্রাসে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মামলার পরিবর্তে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) কার্যক্রমের মাধ্যমে তর্কিত বিষয় সুরাহা করতে ব্যবসায়ীদের সব সময় উৎসাহিত করছে এনবিআর। বর্তমানে অ্যাপিলাত ট্রাইব্যুনালের আওতায় আয়কর খাতের জন্য সাতটি বেঞ্চ এবং মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও শুল্ক খাতের জন্য তিনটি বেঞ্চ রয়েছে। উচ্চ আদালত ও রাজস্ব-সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালগুলোয় ঝুলে আছে ২২ হাজারের বেশি মামলা। আয়কর, ভ্যাট ও আমদানি শুল্কের ওই সব মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় সম্ভব হচ্ছে না।
অবশ্য ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোনো ব্যবসায়ীই খুশিতে-স্বেচ্ছায় আদালতে যায় না। ব্যবসায়ীরা তখনই আদালতের দ্বারস্থ হন, যখন ন্যায়বিচার পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তাছাড়া আপিল কমিশনার ও আপিলাত ট্রাইব্যুনালে কাস্টমস কর্মকর্তারাই মামলা পর্যালোচনা করেন।
সে ক্ষেত্রে অনেক সময় নিজ ক্যাডারের অপর কর্মকর্তার দেয়া আদেশের বিরুদ্ধে রায় দিতে চান না অনেকে। আবার দুদকের ভয়ও আছে। তাছাড়া কোর্টে মামলা বছরের পর বছর আটকে থাকার দায় তো ব্যবসায়ীদের নয়। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে যে বিষয়ে আইনগত প্রতিকার চাওয়ার অধিকার সবারই রয়েছে। মামলা কিংবা রাজস্ব ঝুলে থাকার দোহাই দিয়ে এত বিশাল অঙ্কের ব্যয় ব্যবসায়ীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নয়। এই সিদ্ধান্ত ন্যায়বিচার ও ব্যবসা সহজীকরণের পরিপন্থী।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, এ সিদ্ধান্ত ব্যবসা সহজীকরণের পরিপন্থী। যেখানে ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে উন্নতি করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে সেখানে এ উদ্যোগ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। আপিল-ট্রাইব্যুনালে আগাম টাকা জমা দেয়ার বিধানটিই বাতিল করা উচিত। কারণ সেখানে টাকা আটকানো হয়ে থাকে। শুধু তারিখ পেছাতে থাকে। সব ব্যবসায়ী সংগঠন এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবে।