করোনা প্রাদুর্ভাবে রফতানি হওয়া পণ্যের মূল্য পরিশোধ বিলম্বিত হওয়ায় সিরামিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর চলতি মূলধন নেমে এসেছিল শূন্যের কোটায়। এ পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। এ অবস্থায় চলতি বছর ঘোষিত বাজেটে উৎপাদন পর্যায়ে সম্পূরক শুল্কারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে বাজেট ঘোষণার পর পরই শুল্ক ছাড় দিয়ে সিরামিক পণ্য আমদানিকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। উৎপাদনে শুল্কারোপের মাধ্যমে নিরুৎসাহিত করে ছাড় দিয়ে সিরামিক আমদানিকে উৎসাহ দেয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, দেশের সিরামিক শিল্পে ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে দেশী-বিদেশী ৩০টি প্রতিষ্ঠান। এ খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে পাঁচ লাখের বেশি মানুষের। রফতানির মাধ্যমে খাতটি প্রতি বছর ৪০০ কোটি টাকার বিদেশী মুদ্রা অর্জন করে। আর স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয় ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি পণ্য। এ পরিস্থিতিতে উৎপাদনে শুল্ক আরোপের পর পরই হঠাৎ করেই আমদানিতে শুল্ক ছাড়ের ঘটনায় বিস্মিত হয়ে দুরভিসন্ধির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
খাতসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে দেশীয় শিল্পের স্বার্থে তাদের প্রস্তাব প্রতিফলিত হয়নি। দেশীয় সব স্যানিটারি পণ্য তথা সিরামিকের সিংক, বেসিন প্যাডেস্টাল, কমোড বা তার অংশ, যেকোনো ধরনের প্যান ও বাথরুমের অন্যান্য ফিটিংস ও ফিক্সার্সের ওপর উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। শিল্পের জন্য ক্ষতিকর এ সিদ্ধান্ত আরোপ করা হতশাজনক বলেও জানান তারা।
এদিকে বাজেট ঘোষণার পর ২৩ জুন হঠাৎ করেই একটি এসআরও জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সেখানে দেখা যায়, আমদানীকৃত বিদেশী টাইলসের ট্যারিফ কমানো হয়েছে প্রতি বর্গমিটারে ১ ডলার। ফলে আমদানি মূল্য ৮ দশমিক ৫ শতাংশ হ্রাস পাবে। এ সিদ্ধান্তের প্রভাবে দেশীও টাইলসের বিক্রি কমে যাওয়ার পথ সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমইএ) সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা এ প্রসঙ্গে বলেন, সংকট মোকাবেলায় সিরামিক সেক্টরের সক্ষমতা অর্জনে করণীয় নির্ধারণে মালিকপক্ষ যখন দিশাহারা, তখন বিদেশে তৈরি টাইলস আমদানি পর্যায়ে ন্যূনতম ট্যারিফ মূল্য এনবিআর কর্তৃক হ্রাস করা হয়েছে। যেখানে দেশীয় পণ্যের ওপরে উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং বিক্রয়কালীন সময়ে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর আরোপ রয়েছে, সেখানে আমদানি পর্যায়ে ট্যারিফ মূল্য হ্রাস করার ফলে বিদেশী পণ্য আমদানিতে উৎসাহিত হবে এবং দেশীয় পণ্য অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে।
দেশীয় স্যানিটারি পণ্য উৎপাদন পর্যায়ে আরোপিত সম্পূরক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছে বিসিএমইএ। এর যৌক্তিকতা সম্পর্কে সংগঠনটি বলছে, এটি বিলাসী পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয় না। নির্মাণ উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হওয়া এ পণ্য স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক। উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের পাশাপাশি বিক্রয়কালীন ১৫ শতাংশ ভ্যাট হিসেবে মূসক প্রদানের পরিমাণ প্রায় ৩৩ শতাংশ হয়ে থাকে। একটি দুই বর্গফুট আয়তনের পলিশ টাইলসের প্রতি বর্গফুটের আনুষঙ্গিক উৎপাদন ব্যয় আমাদের এখানে গড়ে প্রায় ৬০ টাকা হয়। এর ওপর ৩৩ শতাংশ মূসক প্রদান করে বিক্রয় ব্যয় দাঁড়ায় ৮০ টাকা। লভ্যাংশ, ডিলার কমিশন ধরে গ্রাহক পর্যায়ে বিক্রয়মূল্য হয় ৯০ টাকা।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এমনিতেই বর্তমানে স্থানীয় বাজারে আমদানীকৃত বিদেশী স্যানিটারি পণ্যের সঙ্গে দেশীয় পণ্যের মূল্য পার্থক্য ক্ষেত্রবিশেষে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ। সেখানে সম্পূরক শুল্ক আরোপের ফলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেলে শুল্ক ছাড় পাওয়া বিদেশী পণ্যের কাছে দেশীয় পণ্যের বাজার টিকে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। আবার বর্তমানে করোনাকালীন সময়ে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে যেখানে এমনিতেই টিকে থাকা যাচ্ছে না, সেখানে নতুন করে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানে বাধা সৃষ্টি হবে।
এনবিআরের অতি সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটি সতর্কতামূলক দাবি করে বিসিএমইএ সচিব জাহেদী হাসান চৌধুুরি বলেন, ২০১৯ সালের ২৯ জুন আমদানিতে ট্যারিফ নির্ধারণ হলো ১২ ডলার। চলতি বছর ২২ জানুয়ারি অর্থাৎ ছয় মাস পরে ১ ডলার কমিয়ে নির্ধারণ হলো ১১ ডলার। বাজেটের সময় বিসিএমইএর তত্পরতায় জুনের ৩ তারিখ এসআরও আবারো আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে ১২ ডলার করা হলো। ১১ দিন পরে ২৩ জুন আবারো ১১ ডলার করে এসআরও জারি হলো। দুবার বাড়ানো হলো আবার দুবার কমিয়ে চারটি এসআরও হলো এক বছরে। এটা সত্যিই অদ্ভুত। সম্ভাবনাময় উদীয়মান সেক্টরটি যেখানে রফতানি বাণিজ্যে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা করছে, সেখানে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করা হলো। আবার শুল্ক ছাড় দিয়ে আমদানিকে উৎসাহ দেয়া হলো। ফলে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় বাজারেই বিদেশী পণ্যের কাছে মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। ফলে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য (কাস্টমস নীতি ও আইসিটি) সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া বলেন, এটা আগের একটা এসআরও। সব এসআরও তো কম্পাইল করে বাজেটের সময় একত্রে দেয়া হয়। এটা ভুলে বাদ পড়েছিল। সেটা আবার অনুমোদন নেয়া হয়েছে, যার কারণে রেটিং করে আবার দিয়ে দেয়া হয়েছে।