কোভিড-১৯ মহামারির কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য স্তিমিত হয়ে পড়ার সময়টিকে সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পরিচালিত শুল্ক আদায় কার্যক্রমকে আন্তর্জাতিক মানের করে তুলতে বেছে নিয়েছে। যাতে এ প্রক্রিয়াটি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উদ্বিগ্নতা কাটিয়ে ওঠার সাথে সাথে সহজ এবং আরও দক্ষভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে পরিচালনা করতে সহায়তা করতে পারে। শুল্ক আদায়কে আধুনিকীকরণের জন্য এএসওয়াইসিইউডিএ ওয়ার্ল্ড, ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো, অটোমেটেড কাস্টমস রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, অনুমোদিত ইকোনোমিক অপারেটর ইত্যাদি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে এনবিআর। শুল্ক পরিচালনার জন্য দ্য অটোমেটেড সিস্টেম ফর কাস্টমস ডেটা (এএসওয়াইসিইউডিএ) একটি কম্পিউটার ভিত্তিক ব্যবস্থা। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) তৈরি করা একটি পদ্ধতি এটি। আঙ্কটাডের লক্ষ্য ছিল সারা বিশ্বের কাস্টমস কর্তৃপক্ষগুলোকে তাদের মূল প্রক্রিয়াগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সময়োপযোগী, সঠিক ও মূল্যবান তথ্য প্রদান করা যাতে সরকারের বিভিন্ন অনুমান এবং পরিকল্পনাকে সহায়তা করা যায়।
২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট নথিতে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে দ্রুত অগ্রগতির চাকা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠতে, আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের সুবিধার্থে শুল্ককে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার বিকল্প নেই।
এতে আরও বলা হয়, এ ব্যবস্থাগুলো যথাসময়ে কার্যকর করা গেলে বাংলাদেশ দ্য ইজ অব ডুয়িং বিজনেস র্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রে উন্নতি করবে, বিনিয়োগ সহজতর হবে এবং দেশের অর্থনীতির চাকা আরও ত্বরান্বিত হবে। এছাড়াও, দেশে বাণিজ্য ও বাণিজ্যের সুবিধার্থে শুল্ক আধুনিকায়ন কৌশলগত অ্যাকশন প্ল্যান ২০১৯-২০২২ গ্রহণ করা হয়েছে।
নথি অনুসারে, শুল্ক বন্দর ও শুল্ক স্টেশনগুলোতে আধুনিক স্ক্যানার স্থাপন করা হচ্ছে। সব স্টেকহোল্ডারকে একক প্ল্যাটফর্মে সংযুক্ত করার জন্য ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো (এনএসডব্লিউ) প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যা আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে ওয়ান স্টপ সেবা সরবরাহ করবে। আধুনিক ও প্রযুক্তি ভিত্তিক এনএসডব্লিউ প্রকল্পের সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন বাণিজ্যকে আরও গতিময় করবে এবং ব্যবসায়ের পরিচালন ব্যয় কমাবে। যা কাগজবিহীন আন্তদেশীয় বাণিজ্য বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হবে। অ্যাডভান্স রুলিং প্রোগ্রাম প্রবর্তনের সাথে সাথে আমদানিকারক বা নতুন উদ্যোক্তারা এখন এইচএস কোডগুলো এবং তাদের পণ্য আমদানির আগে উৎসের নিয়মগুলো সম্পর্কে জানতে পারবে।
২০২২ সালের মধ্যে ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো (এনএসডব্লিউ) ৩৯টি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার পরিষেবাগুলোকে একীভূত ব্যবস্থার আওতায় রপ্তানি-আমদানি প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে। এ ব্যবস্থাটি কার্যকর করার পরে, আমদানির সময় কমে দুই দিনে এবং রপ্তানির সময় এক দিনে কমে আসবে। বর্তমানে বিভিন্ন কাস্টমস বন্দরগুলোর মাধ্যমে আমদানি পণ্য ছাড়ে আট দিন এবং রপ্তানি পণ্যের জন্য পাঁচ দিনের প্রয়োজন হয়।
এনবিআরের তথ্যমতে, ব্যবস্থাটি চালু হয়ে গেলে সময় কম লাগার কারণে বাণিজ্যের জন্য ব্যয়ের ক্ষেত্রে মোট তিন লাখ ১৯ হাজার আমদানিকারক এবং রপ্তানিকারক উপকৃত হবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের ফাস্ট ট্র্যাক সুবিধার মাধ্যমে পণ্য দ্রুত সময়ের মধ্যে সরবরাহ নিশ্চিত করতে অথোরাইজড ইকোনমিক অপারেটর (এইও) ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। একজন এইও ব্যবসায়ী হলেন এমন এক পক্ষ যারা বিশ্ব শুল্ক সংস্থা (ডব্লিউসিও) মানের বা এর সমমানের বা অনুমোদিত সাপ্লাই চেইন সুরক্ষা মানের যা জাতীয় শুল্ক প্রশাসন দ্বারা স্বীকৃত। এইও স্বীকৃতি অর্জন বলতে সাপ্লাই চেইন সুরক্ষা নির্দেশ করে। তদুপরি, ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি বা সংস্থাগুলো ব্যতীত সকলের জন্য পণ্য সরবরাহের গতি বাড়ানোর জন্য সরকার আইটি-ভিত্তিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং ছাড়পত্র-পরবর্তী নিরীক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।
এনবিআরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, আমরা যদি এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে পারি তবে এটি রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে আমাদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হবে। এ অটোমেশন পদ্ধতি রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির পাশাপাশি রপ্তানি ও আমদানি কার্যক্রমের ঝামেলা কমাবে যার ফলে ব্যবসা ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
এদিকে গত সোম-মঙ্গলবার এনবিআর চেয়ারম্যান যথাক্রমে আয়কর ও কাস্টমস-ভ্যাটের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল সভা করেন। জানা গেছে, এতে নতুন অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন ও প্রাক্কলিত লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে অর্জন করা যায়, সে বিষয়ে কৌশল নির্ধারণ করতে এই সভার আয়োজন। সভায় এনবিআরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সদস্যরা নতুন অর্থ বছরের রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেন। এতে আয়করের কমিশনারসহ মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন পদমর্যাদার ৪৬৪ জন কর্মাকর্তা ধাপে ধাপে সভায় অংশ নেন। আর কাস্টমস-ভ্যাটের কমিশনারসহ ১০০ জনের বেশি কর্মকর্তা এতে অংশ নেন।
নভেল করোনা ভাইরাস সংকটের কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বাজেট ঘোষণার পর থেকেই এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্তকর্তারা করোনার এই সংকটে কিভাবে রাজস্ব আদায়ের গতি আগের চেয়ে বাড়ানো যায় ও কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়-সেই বিষয় নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যেই আগে থেকে পরিকল্পনা ও আলোচনা করছেন বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে। সভার এনবিআর চেয়ারম্যান ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে তিনি তার সার্বিক অবস্থান তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে সুনির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনার কথাও জানান।
২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা যেখানে এনবিআর থেকে আসবে প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। নন-এনবিআর উৎস থেকে আসা রাজস্ব ধরা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং করবিহীন রাজস্ব ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা।
এনবিআরের নির্ধারিত আয়ের মধ্যে ১ লাখ ৩ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা আসবে আয়, মুনাফা এবং মূলধন কর থেকে, এক লাখ ২৫ হাজার ১৬২ কোটি টাকা আসবে ভ্যাট থেকে, সম্পূরক কর থেকে আসবে ৫৭ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা, আমদানি শুল্ক থেকে আসবে ৩৭ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা, রপ্তানি শুল্ক থেকে আসবে ৫৫ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক থেকে আসবে তিন হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর থেকে আসবে ১ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা।